উচ্চ সিসির আধুনিক গাড়ি কম সিসি দেখিয়ে শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করেছেন তিনি। ২০১৩ সালের ২৭ এপ্রিল বিল অব এন্ট্রি নং- সি ৩৪২৭ তে অডি আর৮ (Audi R8) ব্র্যান্ডের ৫২০৪ সিসি গাড়িকে ২৫০০ সিসি দেখিয়ে প্রায় ১৫ কোটি ৪৮ লাখ ৩০ হাজার ৪১০ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন তিনি। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে শুল্ক গোয়েন্দার তদন্তে বিশাল অংকের এই রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার ঘটনার সতত্য মিলেছে। বলছিলাম ড. এস এম হুমায়ুন কবিরের কথা। যিনি কাস্টমসের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। অবৈধভাবে এমন নানা পন্থা অবলম্বন করে বহু দুর্নীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ড. এস এম হুমায়ুন কবির ছিলেন অন্তত চতুর একজন কর্মকর্তা। তবে সেই গুণ তিনি ভালো কাজে ব্যবহার না করে করেছেন অসৎ কাজে। দুর্নীতির নানা পন্থা অবলম্বন করে নামে বেনামে নিজে বনে গেছেন অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক। এছাড়াও ভাই-বোন ও আত্মীয় স্বজনের নামেও গড়েছেন সম্পদ। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে চাটুকারিতা ও তেলবাজি করে বিভিন্ন দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে পরবর্তীতে দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ড. এস এম হুমায়ুন কবিরের ধূর্ততা বুঝতে পেরে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে বসালে সেখানেও থেমে থাকেনি তার দুর্নীতি অবলম্বনে নানা পন্থা। হুমায়ুন কবির তার নিজের দপ্তরে ত্রাস সৃষ্টি করায় চাকরি হারানোর ভয়ে মুখ খুলেননি কেউ। এছাড়াও বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারদের দুর্বলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় ড. এস এম হুমায়ুন কবিরের সাথে। তিনি দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, ‘ অডি গাড়ির শুল্ক ফাঁকির বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা কার্যক্রম দুইবারে হয়েছিলো। পাশাপাশি আদালতের পর্যবেক্ষণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সম্ভবত আপনার কাছে শুল্ক গোয়েন্দার প্রথম পর্যবেক্ষণ আছে। কিন্তু নিশ্চয়ই দ্বিতীয়টা এবং আদালতের রায় আপনার কাছে নাই। গাড়ি এক্সামিনের দায়িত্ব কমিশনারের নয়। এই গাড়ি পরিক্ষণ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেখলে বোঝা যাবে এটি সহকারী কমিশনার পর্যায়ে শুল্কায়িত হয়েছিল।’
ড. এস এম হুমায়ুন কবির আরও বলেন, ‘রুমি ফিস ফিডের মালিক অথবা হাফিজুর রহমান লিপুর সাথে আমার কোনো ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত সম্পর্ক নাই। তার সাথে আমার কখনো দেখাও হয় নাই, কথাও হয় নাই। আমি কোনোদিন রুমি ফিস ফিডে ঢুকিও নাই। এছাড়াও আমজাদ হোসেনের কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার আমি কিনি নাই। তার সাথে যৌথভাবে কোনো ঋণ গ্রহণ করিনাই। কাজেই ঋণ খেলাপি হওয়ার প্রশ্নেই আসে না।’
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, ‘জরিমানা কম বা বেশি আরোপ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হাইকোর্টে আপিল করে থাকেন। শুল্ক আইন (ধারা-১৯৬) অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল একটি দেওয়ানি আদালত। একজন কাস্টমস কর্মকর্তা ও একজন জেলা জজ নিয়ে গঠিত। এখানে এককভাবে রায় দেয়ার কোনো সুযোগ নাই। এই ধরনের মামলায় হাইকোর্ট থেকে কাস্টমস ট্রাইব্যুনালের রায় অবৈধ ঘোষনা না হওয়া পর্যন্ত কাস্টমস ট্রাইব্যুনালের রায় অবৈধ এটিও বলার সুযোগ নাই। আমার জানা মতে আমার যৌথ বেঞ্চ হতে এমন কোনো রায় অদ্যবধি হাইকোর্ট হতে ক্ষমতা বহির্ভুত মর্মে প্রকাশিত হয় নাই।’
পরবর্তীতে এসব অভিযোগের বিষয়ে তার সহকারী রাব্বির সঙ্গে কথা বলতে বলেন ড. এস এম হুমায়ুন কবির। রাব্বির সঙ্গে কথা হলে তিনি দ্য সাউথ এশিয়ান টাইমসকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
ড. এস এম হুমায়ুন কবিরের বাড়ি যশোর জেলার পুরোতন কসবা উপজেলার পালবাড়ি মোড়ে। ২০০১-২০০৭ সাল পর্যন্ত নিজেকে বিএনপি-জামায়াতের কর্মী পরিচয় দিয়ে নানা সুবিধা নিয়েছেন। এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে পাল্টে ফেলেন নিজের পরিচয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক এক সহকারী একান্ত সচিবের সহযোগিতায় গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার রাতইলেলিকুর রুমি ফিড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের পাশে জমি ক্রয় করেছেন প্রায় ১৫০ বিঘা। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। এমনকি খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা এসএম আমজাদ হোসেনের মালিকানাধীন খুলনা প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের শেয়ার বাজার ও খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত দুর্নীতি ও অনিয়মের সাথে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
তথ্য বলছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করার আগে ড. এস এম হুমায়ুন কবির অভিভুক্ত কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কমিশনার হিসেবে বহাল ছিলেন। সে সময় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। তার বোন ও আত্মীয় স্বজনের নামে প্রায় ৬টির বেশি বন্ডেড প্রতিষ্ঠান খুলেন। সেই সব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি প্রাপ্যতা নিয়ে ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন (ইউডি) ব্যতীত বন্ডের আওতায় শুল্কমুক্ত কাঁচামাল এনে তা খোলা বাজারে বিক্রি করতেন। বাজারে যেসব প্রতিষ্ঠান হুমায়ুন কবিরের প্রতিষ্ঠানের প্রতিযোগী ছিল, ক্ষমতার অপব্যবহার করে সেসব প্রতিষ্ঠানের পণ্য আটকে রাখতেন তিনি। নানা অভিযোগ এনে সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হতো। পরবর্তীতে সেসব প্রতিষ্ঠানের কাছে থেকে মোটা অংকের অর্থ আদায় করে মামলা নিষ্পত্তি করতেন এই হুমায়ুন কবির। ভুক্তভোগী এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে অভিযোগ জমা দিলেও কোনো প্রতিকার পাননি। বরং কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
সূত্র বলছে, আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর বন্ড কমিশনারেট থেকে ড. এস এম হুমায়ুন কবিরকে সরিয়ে কাস্টমস ও ভ্যাট আপীলাত ট্রাইব্যুনালে বদলি করা হয়। কিন্তু সেখানেও দুর্নীতির সম্রাজ্য গড়ে তোলেন তিনি। বিভিন্ন কাস্টমস হাউজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের রাজস্ব সুরক্ষায় দায়েরকৃত মামলা বেআইনিভাবে নিজের বিচারক হওয়ার ক্ষমতা অপব্যবহার করে মোটা অংকের অর্থের বিমিনয়ে আমদানিকারকের পক্ষে রায় দিয়েছেন তিনি। পরবর্তীতে তার এ সকল রায়ের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কাস্টমস কর্তৃপক্ষ উচ্চ আদালতে মামলা করে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করে। সে সময় এ বিষয়ে একাধিকবার এনবিআর চেয়ারম্যানকে অবগত করেন অ্যার্টনি জেনারেল আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান।
এ বিষয়ে অ্যার্টনি জেনারেল আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগে চেষ্টা করা হয়। তবে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিলেও কোনো উত্তর আসেনি।
এসএটি/জেডএম