ঢাকা,   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪

The South Asian Times | সাউথ এশিয়ান টাইমস

নারান্দিয়ার হাতে ভাজা মুড়ি যাচ্ছে দেশের ৮ জেলায়, জিআই আবেদন করা হবে: ডিসি

কাজল আর্য, টাঙ্গাইল প্রতিনিধি:

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ২৮ মার্চ ২০২৪

নারান্দিয়ার হাতে ভাজা মুড়ি যাচ্ছে দেশের ৮ জেলায়, জিআই আবেদন করা হবে: ডিসি

টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার নারান্দিয়ার মুড়ির চাহিদা দেশজুড়ে। পবিত্র রমজান মাসের ইফতারির রকমারি উপাদানের মধ্যে মুড়ি অত্যাবশকীয়। মুড়ির চাহিদা সারাবছর ব্যাপী থাকলেও রোজার সময় উৎপাদন এবং বিক্রি বহুগুণে বেড়ে যায়। ফলে মুড়ি ব্যবসায়ীরা বছর জুড়ে অপেক্ষায় থাকেন রমজান মাসের জন্য। আবার অনেকে এ মাসে সিজনাল ব্যবসা হিসেবে এই মাসে মুড়ি উৎপাদন এবং বিক্রি করে থাকেন। বর্তমানে এখানকার মুড়ি তৈরির কারিগর ও ব্যবসায়ীদের দম ফেলার ফুসরত নেই। এদিকে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক কায়ছারুল ইসলাম বলেন হাতে ভাজা মুড়ির ব্র্যান্ডিং ও আরো প্রচার প্রসারের জন্য জিআই (ভৌগলিক নির্দেশক) অবেদন করা হবে।


টাঙ্গাইলসহ দেশের ৮ জেলায় মুড়ি সরবরাহ হয়ে থাকে জেলার কালিহাতীর নারান্দিয়া থেকে। এখানকার উৎপাদিত মুড়ির সুনাম দেশের বিভিন্নস্থানে। মুড়ি উৎপাদনের সাথে নারান্দিয়ার মানুষ অনেক পূর্বে থেকেই জড়িত। এখানে দুইভাবে মুড়ি উৎপাদিত হয়, হাতে ভেজে ও মেশিনের সাহায্যে। মুড়ি উৎপাদনকারি এলাকাগুলোর মধ্যে নারান্দিয়া শীর্ষে। 

নারান্দিয়ার শতাধিক বাড়িতে হাতে ভেজে মুড়ি উৎপাদিত হয়। মেশিনের সাহায্যে মুড়ি উৎপাদন নতুন সংযোজন হলেও হাতে ভেজে মুড়ি তৈরি এবং বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে শতাধিক পরিবার অনেক আগে থেকেই। বিশেষ করে মোদক সম্প্রদায়।

এছাড়া উপজেলার নারান্দিয়া, মাইস্তা, নগরবাড়ী, দৌলতপুর, লুহুরিয়া ও সিংহটিয়াসহ প্রায় পনেরটি গ্রামের কয়েক’শ পরিবার হাতে ভেজে মুড়ি তৈরি করে থাকে। একজন ব্যক্তি ১ দিনে এক থেকে দেড় মণ চালের মুড়ি ভাজতে পারেন। প্রতি মণ চালে ২২ থেকে ২৩ কেজি মুড়ি হয়। প্রতি কেজি মুড়ি পাইকারি ৯০-১০০ টাকা এবং খুচরা একশ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে। মূলত গ্রামের মহিলারাই হাতে ভেজে গুণগত মানসম্মত মুড়ি তৈরি করেন।

দৌলতপুর গ্রামের রাধা রানী মোদক কালের কণ্ঠকে বলেন আমরা বংশ পরম্পরায় এ মুড়ি ভাজা ও ব্যবসার সাথে জড়িত। আমি ৩৫ বছর ধরে মুড়ি ভাজি। ধান সিদ্ধ করে রোদে শুকানোর পর আবার সেই ধান মেশিনে মাড়াই করে মুড়ি ভাজার জন্যে চাল তৈরি করা হয়। পরে সেই চাল দিয়ে লবণ জলের মিশ্রণে আগুনে তাপ সহ্য করে বিশুদ্ধ মুড়ি ভাজতে অনেক পরিশ্রম হয়। সবকিছুর দাম বেশি। পরিশ্রমের তুলনায় তেমনটা লাভ হয় না। 
 
অধীর মোদক কালের কণ্ঠকে বলেন মুড়ি ভাজার প্রতি মন ধান ১,৩০০ টাকা। এক মণ ধানের মুড়ি ভাজতে খড়ি, লবণ, যাতায়াত ও ধান ভাঙানোর খরচ আরো ১৫০ টাকা। সব খরচ বাদে বেশি লাভ হয় না। 

কনিকা রানী মোদক ও সুরেন্দ্র কুমার বর্মন বলেন এক মণ ধানের মুড়ি ভাজলে ৪০০-৫০০ টাকা লাভ হয়। তা দিয়ে চলে না। আমরা সরকারি সহযোগিতা চাই। প্রতিবছরই চিৎকার করে বলি । কিন্তু কোন কাজে আসে না।   

মুড়ির কারিগরসহ সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ টাকার হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদন এবং কেনাবেচা হয়। তবে পরিশ্রমের লাভ বেশির ভাগই চলে যায় মধ্যসত্বভোগীদের পকেটে। রমজান মাসে দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা পিকআপ, ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনে বস্তাভর্তি মুড়ি কিনে টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত এলাকায় বিক্রি করেন। যাতায়াত ব্যবস্থা ভাল থাকায় পার্শ্ববর্তী সিরাজগঞ্জ, ঢাকা, ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, বগুড়া, শেরপুর ও গাজীপুরে নারান্দিয়ার মুড়ি সরবারহিত হয়। 

তবে প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদনকারীরা। মেশিনে মুড়ির ভাজতে সময় কম লাগে, কিন্তু তুলনামূলকভাবে লাভ বেশি। অন্যদিকে হাতে মুড়ি ভাজতে সময় বেশি লাগে কিন্তু লাভ সামান্য। ফলে হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদনকারীরা দিনদিন এই কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় ধাবিত হচ্ছেন এবং অনেকেই চলে গেছেন। এই পেশাকেই টিকিয়ে রাখতে উৎপাদনকারী এবং ব্যবসায়ীরা সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।

সততা মুড়ির মিলের স্বত্বাধিকারী শংকর চন্দ্র মোদক কালের কণ্ঠকে বলেন রমজানে আমরা অনেক সময় মোবাইলেও মুড়ির অর্ডার নিয়ে সরবারহ করে থাকি। তাছাড়া নির্দিষ্ট বাজারে স্থায়ী গ্রাহকরা মুড়ি ক্রয় করে থাকেন। রমজান ছাড়া বছরের অন্য সময়ে অর্ধেকে নেমে আসে। শতাধিক পরিবার প্রত্যক্ষভাবে ও বিপুল সংখ্যক মানুষ পরোক্ষভাবে মুড়ি ব্যবসার সাথে জড়িত থেকে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। ফলে রমজানে কাজের চাপে দম ফেলার সময়টুকু পায়না মুড়ি উৎপাদনকারীরা। তিনি আরো বলেন নারান্দিয়ার মুড়ি বিসিক থেকে প্যাকেটিং করে দেশের বাইরেও যায়।

শংকর মোদক আরো বলেন আমরা প্রতি কেজি মুড়ি ৭০ টাকায় বিত্রি করি। খুচরা ৮০-৯০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। ৫০ কেজি চালের বস্তায় ৪৩-৪৪ কেজি মুড়ি হয়। রমজান মাসে আমাদের মিলে গড়ে ১ লঅখ টাকার কেনাবেচর হয়ে থাকে।

এদিকে মেশিনের সাহায্যে বিপুল পরিমান মুড়ি প্রতিনিয়ত উৎপাদিত হলেও হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। মেশিনে ভাজা মুড়ি সাদা ও লম্বা করতে ক্ষতিকর রাসায়নিক ইউরিয়া কিংবা সোডা ব্যবহারের অভিযোগ থাকায় একশ্রেণির মানুষ সর্বদাই বিষমুক্ত হাতেভাজা মুড়ি খেয়ে থাকেন। 

নারান্দিয়া ইউপি সদস্য ইব্রাহীম মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন মেশিনের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারছেন না হাতে ভাজা মুড়ির কারিগররা। ফলে জীবন জীবিকার তাগিদে তারা অন্য পেশায় ছুটছেন। প্রয়োজন যথাযথ ব্যবস্থাপনা।

দৌলতপুর গ্রামের বাসিন্দা কালিহাতী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান মজনু বলেন আমাদের এলাকাটি মুড়ি উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ। কিন্তু পরিশ্রমের তুলনায় লাভ কম হওয়ায় হাতে ভাজা মুড়ির কারিগররা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। নারান্দিয়ায় মুড়ি কেনাবেচার একটি নির্দিষ্ট বাজার দরকার। সরকার থেকে হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদনকারী ব্যক্তি এবং পরিবারগুলোকে বিশেষ ঋণ সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন। 

কালিহাতী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজহারুল ইসলাম তালুকদার বলেন, টাঙ্গাইল তথা বাংলাদেশের মধ্যে মুড়ি উৎপাদনের অন্যতম স্থান কালিহাতীর নারান্দিয়া। এখানকার উৎপাদিত লাখ লাখ টাকার মুড়ি সারাদেশে সরবরাহ হচ্ছে। এটি একপ্রকার কুটিরশিল্প। মানুষের চাহিদা পূরণে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের যথাযথ উদ্যোগ প্রয়োজন। বিশেষ করে হাতেভাজা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক কায়ছারুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন নারান্দিয়ার হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা ও সুনাম রয়েছে। এরসাথে জড়িত প্রান্তিক মানুষদের অবশ্যই সরকারি সাহায্য করার সুযোগ আছে। তাদের তালিকা করে কম সুদে ঋণ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে সাহায্য করার উদ্যোগ নিবো। সেইসাথে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখানকার হাতে ভাজা মুড়ির ব্র্যান্ডিং ও আরো প্রচার প্রসারের জন্য জিআই অবেদন করা হবে।


ফটো ক্যাপসন- লবণ জল দিয়ে হাতে ভেজে বিশুদ্ধ মুড়ি উৎপাদন করছেন এক মহিলা কারিগর। মুড়ির গ্রাম খ্যাত টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার দৌলতপুর থেকে তোলা
 

সর্বশেষ

Advertisement

সর্বাধিক জনপ্রিয়