
প্রশ্নটা আমার মাথায় আসে এক অমাবস্যার রাতে।
আমার মধ্যে সাহিত্য প্রতিভার কিছু নেই। এ কারণে, শুধু কল্পনা করে কিছু লেখা হয় না আমার। আশেপাশে যা কিছু ঘটে, যা কিছু দেখি বা শুনি - তা থেকেই নিজের মত করে কিছু লিখি আমি। তবে আমার ‘পাগলামামা’ ব্যতিক্রম। ‘পাগলামামা’ বইটি মূলত কল্পনা নির্ভর। কিন্তু, যেহেতু কল্পনা করে আমার মাথায় লেখা আসেনা - পাগলামামা বইটির একটি অধ্যায় লেখার জন্য একটি রাত আমাকে ঢাকা চিড়িয়াখানায় কাটাতে হয়। এটি বাংলা ১৪২২ সনের কথা। গল্পের চাহিদা অনুযায়ী বাংলা পঞ্জিকা দেখে আমাকে কৃষ্ণপক্ষের একটি রাত ঠিক করতে হয়। যারা বইটি পড়েছেন, তাঁরা বিষয়টি বিস্তারিত জানেন। রাতটি ছিল অমাবস্যার রাত। কথা ছিল চিড়িয়াখানার পাহারারত লোকজন সেই আঁধার রাতের কয়েক ঘণ্টা আমাকে একা থাকার সুযোগ করে দেবেন। আমি কৃতজ্ঞ তাঁদের প্রতি এই কারণে যে, তাঁরা আমাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এ কারণে চিড়িয়াখানার তখনকার কিউরেটর মহোদয়ের প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতার কথা ‘পাগলামামা’ বইটিতে যথানিয়মে উল্লেখ করা হয় ।
ঢাকা চিড়িয়াখানার ভিতরে অবস্থিত কিউরেটর অফিসে সে রাতে আমাকে চিড়িয়াখানা সম্বন্ধে বিস্তারিত ধারণা দেওয়া হয়। রাতে দর্শনার্থী প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ কারণে চিড়িয়াখানার ভিতরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা নেই । অমাবস্যার রাত । এমনিতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। ব্রিফিং শেষে চিড়িয়াখানার দুজন প্রহরী অন্ধকার সেই রাতে আমাকে একটি পুকুরের ধারে রেখে চলে যান। প্রহরী দুজন আলো নিয়ে চলে যেতেই, গাঁড় অন্ধকার আমাকে ঘিরে ধরে। এমন অন্ধকার যে, নিজের হাত পর্যন্ত দেখা যায় না। চারিদিকে পোকামাকড়ের বিচিত্র সব ডাক। বিভিন্ন পশুপাখি থেকে আসা বিচিত্র সব শব্দ কেমন যেন ভূতুড়ে মনে হয়। গাছপালাগুলো নিকষ কালো মূর্তির মত দাঁড়িয়ে। আশেপাশের কেমন এক শোঁ শোঁ শব্দে গা শিরশির করা আতঙ্ক আমাকে পেয়ে বসে। আমি জানি, একটু দূরেই কয়েকজন প্রহরী আছেন; চিড়িয়াখানার কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছেন। তাঁরাও খুব বেশি দূরে নয়। শুনেছি চিড়িয়াখানার ভিতরে আনসার ক্যাম্পও আছে। আমি নিজে একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। সাহস সঞ্চয়ের জন্য নিজের পদমর্যাদার কথাও ভাবতে থাকি আমি। ভয় পাওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই বলে নিজের মনকে বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সবই বৃথা। ভয়ে আমার শরীর ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে। দেহটা নিশ্চল পাথরের মত ভারি মনে হয়। পুরোপুরি জ্ঞান হারিয়েছিলাম কিনা জানিনে। তবে চিড়িয়াখানার সেই দুজন প্রহরী যথাসময়ে না এলে শেষ পর্যন্ত আমার পরিণতি কী ছিল- তা আজও আমার কল্পনায় আসে না।
সে রাতেই আমার মাথায় এই প্রশ্ন আসে,
আমি ভয় পেলাম কেন?
আমার ভয় পাওয়া যে যৌক্তিক ছিল না, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
তাহলে, আমি ভয় পেলাম কেন?
আসলে মানুষ ভয় পায় কেন?
এ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। আমার মনে হয়েছে, আমার নিজের ভয় পাওয়ার মূলে রয়েছে শিশুকালে আমার মায়ের সেই ঘুমপাড়ানি গান -
খোকা ঘুমালো,
পাড়া জুড়ালো,
বর্গী এলো দেশে;
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে,
খাজনা দিব কিসে?
গানটি সুর করে গাওয়া হলেও, এই গানের মধ্যে কুখ্যাত বর্গী দস্যুদের কথা বলে শিশুদের ভয় দেখানো হয়েছে। এভাবে শিশুদের ঘুম পাড়ানোর জন্য রাক্ষস খোক্কসসহ বিভিন্ন দৈত্যদানোর কথা বলা হয়। আমার এক সহপাঠী এক সময় তাঁর এলাকার নামকরা গুন্ডা ছিলেন। তাঁর মুখে শুনেছি সে এলাকার মায়েরা তাঁর কথা বলে ভয় দেখিয়ে শিশুদের ঘুম পাড়ায়। এসবের মূল কথা, ভয় পেয়ে যেন শিশুটি ঘুমিয়ে যায়। শিশুটি ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়, না ঘুমিয়ে যায় -তা কখনো তলিয়ে দেখা হয় না। আমার মনে হয়েছে, বাস্তবে এই ভয় শিশুর অবচেতন মনে স্থায়ী ভাবে গেঁথে যায়। ভবিষ্যতে সে যত ক্ষমতাধর মানুষ হোক না কেন, যত বড় পদের মানুষ হোক না কেন, যে কোন নির্জন স্থানে বা অপ্রত্যাশিত কোন পরিস্থিতিতে পড়লেই সে ভয় পায়।
তবে ভয় দেখিয়ে শিশুদের ঘুম পাড়ানো আমাদের সংস্কৃতির একটি অঙ্গ বলা যায়। ফলে, কেউ এটাকে অস্বাভাবিক মনে করেন না। কিন্তু আমার মনে হয়, ভয় দেখানো শিশু বড় হয়ে যদি দেশের সেনাপ্রধানও হন, তাহলেও তিনি ভীতু হতে বাধ্য। তাই যদি হয়, তাহলে, এটা কোন দেশের জন্য শুভ লক্ষণ নয়।
আমার মনে হয়েছে, শিশুকে ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ানোর ক্ষতিকর প্রভাব শিশুর মা-বাবাকে বোঝাতে পারলে; শিশুদের সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের পথের এ ধরনের অন্তরায় দূর করা সম্ভব। এ বিষয়ে গবেষণা হতে পারে; বিশেষজ্ঞ জনের মতামত নেওয়া যেতে পারে। সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। রাতারাতি সুফল পাওয়া না গেলেও, ভবিষ্যতে একটি সাহসী ও সুন্দর জাতি গঠনে এ ধরনের কার্যক্রম কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
১২ জানুয়ারি, ২০২৪। ইস্কাটন গার্ডেন, ঢাকা।