
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ববি) জুলাই-আগষ্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নানাভাবে বাধা প্রদানকারী ও হামলাকারী সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি অনাস্থা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নানাভাবে বাধা প্রদান ও আন্দোলনে প্রত্যক্ষ হামলা চালায় সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীরা। আন্দোলন চলাকালীন তারা নানাভাবে আন্দোলনে বাধার সৃষ্টি এবং হামলা করে আন্দোলন বন্ধের চেষ্টা করে সরাসরি শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২৯ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে গ্রাউন্ড ফ্লোরে মিটিংরত আন্দোলনের সমন্বয়কসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, যাতে ১৫ জন আহত হয়ে শেরে বাংলা মেডিকেলে চিকিৎসা নেয় ও ভর্তি হয়।
এ ছাড়াও ১ আগস্টে বিক্ষোভ সমাবেশ করতে জড়ো হওয়া শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় হয়রানি, হেনস্তা, ক্যাম্পাসে প্রবেশে বাধা প্রদানসহ পুলিশ প্রশাসনের সাথে মিলে আন্দোলন বানচাল করা ও সমন্বয়কদের পুলিশি গ্রেফতারে সহযোগিতা করে ছাত্রলীগের কর্মীরা। এগুলোর প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, ক্যাম্পাসে সংঘটিত এসব সহিংসতার ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এতো সব ঘৃণিত কার্যক্রমের পরেও এখনো সেসব হামলাকারী ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
তারা আরো জানান, এসব হামলাকারীদের মধ্যে কেউ কেউ এখনো নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। ক্যাম্পাসের আশেপাশে ঘুরতেও দেখা যায় অনেককে। যাদের হাতে এখনো শহীদের রক্ত লেগে আছে এবং ফ্যাসিস্টের দোসর হিসেবে যারা কাজ করেছে তাদের এইভাবে বিচারহীনভাবে পার পেয়ে যাওয়াকে শিক্ষার্থীরা হাজার হাজার শহীদদের রক্তের সাথে বেইমানি বলে মনে করছেন তারা। যার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ, প্রশাসনের প্রতি অনাস্থা ও অসন্তোষ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
হামলায় আহত একাধিক শিক্ষার্থী সূত্রে জানা যায়, আন্দোলন চলাকালীন সেসব হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ পরিচয়ধারী নেতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আবুল খায়ের আরাফাতের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করেন- আবিদ হাসান (গণিত বিভাগ; ২০১৫-১৬ সেশন), মাহমুদুল হাসান তমাল (আইন বিভাগ; ২০১৭-১৮ সেশন), আল সামাদ শান্ত (ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ; ২০১৭-১৮ সেশন), খালেদ হাসান রুমি (ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ; ২০১৭-১৮ সেশন), সাইফ আহমেদ (অর্থনীতি বিভাগ; ২০১৭-১৮ সেশন),সাব্বির হোসেন (বাংলা বিভাগ; ২০১৮-১৯ সেশন), শরীফুল ইসলাম (একাউন্টটিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ; ২০১৮-১৯), রাকিবুল হাসান (বাংলা বিভাগ; ২০১৮-১৯)।
এ ছাড়াও মার্কেটিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের টিকলী শরিফ, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী অশোক আলী, আইন বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শাহারিয়ার সান ও শেখ মোহাম্মদ সাইফসহ নাম না জানা আরো ১০-১৫ জন সেসব হামলায় অংশ নেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে হামলায় আহত শিক্ষার্থী মো.সিরাজুল ইসলাম বলেন, আন্দোলন চলাকালীন ২৯ জুলাই ছাত্রলীগের কর্মীরা প্রক্টরিয়াল বডি ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে তাদের সামনেই আমাদের উপর এই ন্যাক্কারজনক হামলা চালায়, যেখানে প্রক্টরিয়াল বডি নীরব ভূমিকাই বলে দেয় ববির তৎকালীন প্রশাসন হয় ছাত্রলীগের চেয়ে দুর্বল ছিল নয়তো ছাত্রলীগকে মদদ দিচ্ছিল। হামলার পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না, যা আমাদের হতাশ করেছে। প্রশাসনের পটপরিবর্তন হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখন পর্যন্ত কোনো লিগ্যাল অ্যাকশন নেয়নি। যা সুস্পষ্টভাবে ববি প্রশাসনের দুর্বলতার প্রমাণ অথবা বিপ্লবকে অবজ্ঞা।
তিনি আরো বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি এসব হামলার ঘটনাকে সুষ্ঠু তদন্ত করে লিগ্যাল পদক্ষেপ নিতে কালক্ষেপণ করে, তাহলে ২৪ এর জুলাইয়ের আহতদের রক্তের সাথে প্রতারণা করা হবে। ববির ছাত্র সমাজ তা মেনে নিবে না। তাই আশা করছি, নতুন এই প্রশাসন অনতিবিলম্বে ছাত্রলীগের অপকর্মের সাথে জড়িতদের আইন অনুযায়ী শাস্তির আওতায় আনবে।
হামলায় আহত আরেক শিক্ষার্থী সুজন মাহমুদ বলেন, ব্যাপারটি খুবই দুঃখজনক, যেখানে সব জায়গায় স্বৈরাচারের দোসরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তবে ববিতে এখনো সেই রকম কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাইনি। আমি অবনতিবিলম্বে এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষীদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।
এই বিষয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অবস্থান জানতে চাওয়ায় আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক শাহেদুল ইসলাম শাহেদ বলেন, হামলাকারীদের বিচারের বিষয়ে আমরা সোচ্চার আছি। প্রশাসনিক পদগুলো ফাঁকা থাকায় আমরা উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি। হামলাকারীদের তালিকা অপরিবর্তিত রয়েছে। আমরা খুব শীঘ্রই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিবো।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড.শুচিতা শরমিন বলেন, আমি তো এখানে নতুন। বিষয়টি আমি দায়িত্বে আসার আগের ঘটনা। তাই বিষয়টা সম্পর্কে তেমন বিস্তারিত জানা নেই। প্রক্টরিয়াল বডি ও সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করে সত্যতা যাচাইপূর্বক বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এসএটি/আরএইচ