মাধবী রানী রবিদাস, বয়স ২৭। কুড়িগ্রামের ঘোগাদহ ইউনিয়নের হাজিরকুটি গ্রামের রবিদাস পাড়ায় তার বাড়ি। তিনিই ঐ এলাকার এ সম্প্রদায়ের একমাত্র শিক্ষিত নারী। এসএসসি পাশ করেছেন তিনি। বাদবাকিরা বড়জোর নিজের নামটা কেউ কেউ লিখতে পারেন, অধিকাংশই পারেন না।
মাধবী রাণী তেমন নারীদের পড়ানোর জন্য এক বয়স্ক শিক্ষার স্কুল চালু করেন। গত ৩ বছর ধরে চলছে সে স্কুল। বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত সরকারী গুদাম ঘরে তার শিক্ষার্থী সংখ্যা বর্তমানে ২৬ জন। তিনি নিজের মতো করে বর্ণ, শব্দ ও বাক্য শিক্ষার পাঠ্যপুস্তক সংগ্রহ করে শিক্ষার্থীদের শেখাতে শুরু করেন। এর মধ্যে ৮ জন শিক্ষার্থী তার নির্ধারিত বই পড়তে-লিখতে শিখে গেছেন। মাধবী রাণী তাদের জায়গায় নতুন আরো ৮ জন সংযুক্ত করেছেন তার স্কুলে। সপ্তাহের ৫ দিন ১০টা থেকে ১২টা তিনি স্বেচ্ছাশ্রমে স্কুল পরিচালনা করে আসছেন। তার এ উদ্যোগ দেখে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিও তার স্কুলে সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছে।
মাধবী রাণী রবিদাস বলেন, আমি স্কুল শুরু করেছি নিজের ইচ্ছে ও সামর্থ দিয়ে। এনজিও বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এখন সহায়তা দিতে শুরু করেছে। তারা পাশে থাকলে ভালো। যদি কখনো না থাকে আমি এই স্কুল চালিয়ে যাবো।
তার স্বামী অরুণচন্দ্র রবিদাস সাইকেল মেকানিক। তারও সম্মতি আছে মাধবীর কাজে। মাধবী সংসারের কাজের পাশাপাশি কেঁচো সার তৈরী করে নিজের কৃষি জমিতে ব্যবহার করেন। এই সার তিনি বিক্রি করে আয়ও করেন। তাছাড়া তিনি গরু-ছাগল, মুরগী পালন করে আয় করেন। তিনি জৈব কীটনাশক তৈরী করে সবজি ক্ষেতে প্রয়োগ করেন। রবিদাস পাড়ার নারীদের কাছে মাধবী খুব জনপ্রিয় ও এক ভরসার মানুষ।
'ক্রিশ্চিয়ান এইড, আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন' সম্মিলিত ভাবে Expanding civic space through active CSO participation and strengthened governance system in Bangladesh (ECSAP) নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রান্তিক নারী, দলিত, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, ট্রান্সজেন্ডার, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
কুড়িগ্রামে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের অংশীদারী এনজিও এএফএডি(AFAD) এর সাথে মাল্টিজার ইন্টারন্যাশনাল, বিএমজেড-পিটি প্রোজেক্টের অধীনে নারীর ক্ষমতায়ন, জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা দূরীকরণ, এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ঘোগাদহ ইউনিয়নের দলটি এই প্রজেক্টের আওতাধীন।
হাজিরকুটি গ্রামের এই দলের ২৪জন নারী
আয়বর্ধক প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের দক্ষতা বাড়িয়েছেন। তারা নিজেদের সংসারে বাড়তি উপার্জন করছেন ও অর্থনৈতিকভাবে অনেকে স্বাবলম্বী হয়েছেন। রিমা রাণী, বিথী রাণী ও টুলটুলি জানান, তারা এখন সংসারের আয় বাড়াতে সহায়তা করায় সংসারে বেশি গুরুত্ব পান। নিজেদের সাপ্তাহিক ১০০টাকা সঞ্চয় থেকে সবার সঞ্চয় বাড়ছে, কেউ কেউ ক্ষুদ্র ঋণ সুবিধাও নিতে পারছেন।
সরস্বতী রাণী, সুমিত্রা রাণী এককালীন সহায়তা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন। তারা বলেন, আগে আমাদের পরিবারগুলোর পেশা ছিল পরিচ্ছন্নতার কাজ, জুতা সেলাই ও মাছ ধরা। তখন সংসারে টানাটানি লেগে থাকতো। এখন আমরা যেকোনো পেশা বেছে নিতে পারি।
সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রশিক্ষন ও সহায়তা পায় দলের সদস্যরা। তার মধ্যে দূর্যোগকালীন সংকট মোকাবেলা প্রশিক্ষণ, বন্যাসহনশীল ধান বীজ, বিভিন্ন সবজীবীজ, বীজতলা তৈরীর ট্রে, কেঁচো সার তৈরীর উপকরণ, এককালীন গরু ও ছাগল, এককালীন অর্থ ও ক্ষুদ্রঋণ অন্যতম।
কিশোরী রাণী, বাতাসী ও ইয়ানুর জানান, তারা গরু ও ছাগল পেয়েছেন এককালীন। মাত্র দেড় বছরে ইয়ানুর ও কিশোরী ৮ টি করে ছাগলের মালিক হয়েছেন।
এই দলের সভাপতি রিমা রাণী জানান, রবিদাস পরিবারগুলোর মাঝে নারীর প্রতি সহিংসতা অনেক কমে গেছে। সমাজেও আমাদের গ্রহনযোগ্যতা বেড়েছে। যেকোন বিরোধ মিমাংসা বা সিদ্ধান্ত গ্রহনে পুরুষদের পাশাপাশি আমরাও মতামত দিতে পারি। আগে যেটা অসম্ভব ছিলো। বাল্য বিবাহের হারও এখন নাই বললেই চলে।
দলের সেক্রেটারী বিথী রাণী বলেন, আমাদের পরিবারগুলোর স্বাস্থ্যগত নানা পরামর্শ বা সেবা এখন সহজে পাই। বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ ন্যায্যমূল্যে দ্রব্যাদি কিনতে পারে দলের সদস্যরা। একসময় পুরুষ সদস্যরাই শুধু কাজে যেতো, আমরা ঘরে বসে থাকতাম। এখন আমরা সবাই কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। তিনি আরো বলেন দলের সদস্যদের বাইরে আমাদের প্রতিবেশিরা, যারা দলের সদস্য নন তারাও আমাদের থেকে শিখছে। তারাও আমাদের মতো করে কাজ করে পরিবার ও সমাজে ভুমিকা রাখছে।
মাধবী রাণী বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সংকট বন্যা। প্রতিবছর বন্যা এলে বাড়িঘর তলিয়ে যায়। তখন কৃষি বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। কেঁচো সার তৈরীর প্রজেক্ট নষ্ট হয়ে যায়। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী নিজে রাস্তায় উঠতে হয়। সে সময় আমরা পুরোপুরি শূণ্য হয়ে যাই। বন্যা শেষ হলে আবার লড়াই শুরু করি বেঁচে থাকার।
এএফএডি নির্বাহী প্রধান সাইদা ইয়াসমিন বলেন,
আমরা কাজ করার পর দলগুলোর পরিচালনা ও সদস্যদের সক্ষমতা তৈরী, আয়মুলক কর্মসূচীর সর্বোত্তম ব্যবহার, নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও পরিবেশবান্ধব কৃষিকাজে উৎসাহিত করা গেছে। তবে আমরা যারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় নিয়ে আসার জন্য কাজ করি তাদের সবচেয়ে বড় সংকট হয় একই শ্রেণীর বৃহৎ জনগোষ্ঠী থেকে বাছাই করে সীমিত পরিসরে দল গঠন করা। ঘোগাদহ হাজিরকুটি গ্রামে ২ শত প্রায় দলিত নারী থেকে মাত্র ২৪ জনের দল করা কঠিন হয়েছিল। আরো অনেক মানুষ আমাদের কার্যক্রমের বাইরে থাকে যাদের জন্য আমরা তেমন কিছু করতে পারি না।
ঘোগাদহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো: আব্দুল মালেক জানান, দলিত সম্প্রদায়ের নারীদের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এখন দৃশ্যমান হচ্ছে। তারা নিজেদের অধিকার সচেতন হচ্ছে। দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করছে। ইউনিয়নের পরিষদের সেবা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তারা আদায় করছে। অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা সচ্ছল হয়েছে পরিবারগুলো।



































