নার্গিসের জীবনের যুদ্ধটা শুরু হয় শিশু বয়সেই। তখন তিনি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছিলেন। ব্রাকের প্রাক- প্রাথমিক স্কুলের জন্য একজন শিক্ষিত নারী দরকার। গ্রামে আর কোন শিক্ষিত নারী না থাকায় নার্গিসকে পঞ্চম শ্রেণী পাশ সার্টিফিকেট নিয়ে নাত্র ৩০০ টাকা বেতনে চাকুরি শুরু করতে হয়েছিল। সময়টা ২০০২ সাল।
স্কুল পরিচালনার পাশাপাশি নার্গিস নিজের পড়ালেখাও চালিয়ে যেতে থাকেন।পরবর্তীতে তিনি বিএ পাশ করেন। নার্গিসের বাড়ি কুড়িগ্রাম সদরের হলোখানা ইউনিয়নের শুভারকুটি গ্রামে।
নার্গিসের দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগেই প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় ছেড়ে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকতার দায়িত্ব পান তিনি। এছাড়া নারী শিক্ষার গুরুত্ব, নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার বিষয়ে বেশ কিছু প্রশিক্ষন গ্রহন করে এলাকার নারীদের জন্যও কাজ শুরু করেন।
সেই কিশোরী বয়স থেকে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে সক্রিয় অংশ গ্রহন করেন তিনি। গ্রামের কিশোরীদের নিয়ে দল গঠন করে বাল্য বিবাহ ঠেকাতে অভিভাবকদের বিরাগভাজন হন প্রায়ই। সেসময় কখনো অভিভাবকদের বুঝিয়ে, কখনও এনজিও বা কখনও প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে এলাকায় ১৩ টি বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করেন তিনি। এখনও তিনি নিজ ও আশেপাশের এলাকার বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি শুভারকুটি গ্রামের কৃষক শফিকুরের ৭ম শ্রেণী পড়ুয়া কন্যা সুমাইয়াকে আত্মীয়ের মাঝে গোপনে বিয়ে দেওয়ার সকল আয়োজন চুড়ান্ত করে ফেলে। খবর পেয়ে বাঁধ সাধেন নার্গিস। তিনি ও তার দল বুঝিয়ে বিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে এনজিও AFAd এর মাধ্যমে প্রশাসনের সহায়তা নিলে বিয়েটা বন্ধ হয়ে যায়।
সুমাইয়ার মা সাহিদা বেগম জানান, আমরা আত্মীয়ের প্ররোচনায় ছোট মেয়েকে বিয়ে দিতে যাচ্ছিলাম। এখন আমরা বুঝে সিদ্ধান্ত নিয়েছি মেয়ের বিয়ের বয়স না হওয়া অবধি বিয়ে দেবো না। সুমাইয়া আবার স্কুলে পড়ছে।
গ্রামের শাপলা (৩০) ১২ বছর আগে নিজে পালিয়ে বিয়ে করেন পাশের গ্রামের কৃষি শ্রমিক রহিম বাদশাকে। শাপলাকে তার শ্বশুরবাড়ি কোনভাবে মেনে নিতে চাচ্ছিল না। প্রায়ই শ্বশুরবাড়ির লোকজন নানা ছুতোয় মারধর করতো। রহিমবাদশা শুরুর দিকে শাপলাকে সহ্য করে কিছুদিন টিকে থাকতে বলতেন। পরে শাপলা যখন ৭ মাসের গর্ভবতী- একদিন প্রচণ্ড মারধর করে মেরে ফেলার চেষ্টা করে রহিম বাদশা। খবর পেয়ে ৯৯৯ ফোন করে নার্গিস পুলিশের সহায়তা নিয়ে সেই বাড়ি থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করায় শাপলাকে। পরে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে।
এঘটনায় স্থানীয় সরকার, থানা ও এলাকাবাসীকে সাথে নিয়ে বার বার আপোস মিমাংসায় ব্যর্থ হন নার্গিস।। দীর্ঘদিন সেই মামলায় আদালতের বারান্দায় ছোটাছুটি শেষে শাপলার পক্ষে রায় আসে। শাপলা এখন রহিমবাদশাসহ সংসারে ভালো আছেন।
লাকি বেগমের ঘটনাটায় আরো বেশি জড়িয়ে যান নার্গিস। নবির হোসেন ও দিলজনের কন্যা লাকি। বিয়ে করেন সিরাজুল ইসলাম নামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে। এক সন্তানের মা লাকিকে প্রায়ই মারধর করতেন সিরাজুল। একদিন লাকিকে মেরে গলায় পা দিয়ে হত্যার চেষ্টা করলে গলার চামড়া মাংস ছিঁড়ে যায়। সেদিনও নার্গিস ৯৯৯ এ ফোন করে পুলিশসহ লাকিকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার হাসপাতালে ভর্তি করে। পুলিশবাদী এই মামলায় নার্গিস সাক্ষী হন। মামলায় শেষ পর্ষন্ত লাকি তার সংসার ফিরে পায়। কিন্তু সাক্ষীকে বিবাদীরা অনেক হয়রানী করে। এমন হাজারো ঘটনার প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছেন নার্গিস।
এই কাজগুলো নিঃসন্দেহে নার্গিসের জীবনে সফলতা যোগ করেছে। কিন্তু ব্যক্তি নার্গিস নিজে তার সংসারে টালমাটাল। তার স্কুল শিক্ষক স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন এমন প্রতিবাদী নারীকে বউ হিসাবে মানতে চান না। তারা নার্গিসকে এনজিও ছাড়তে বলেন নইলে সে স্বামীর বাড়িতে থাকতে পারবেন না। কোন নারী বিপদে পড়ে নার্গিসকে ফোন দিলে তার স্বামী ফোন আছাড় মেরে ভেঙে ফেলে। এমন লাঞ্ছনা চলতে চলতে এক ছেলেসহ নার্গিস বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন। বাবা, মা, ভাইও নার্গিসকে নিজের সংসার সামলাতে না পারার দায় দেয়। কটু কথা শোনায়। তবুও অদম্য নার্গিস এলাকার নারীদের জন্য জীবন যেন বাজি রেখেছেন।
নার্গিস গ্রামের নারীদের অধিকার সচেতন করতে মরিয়া। তিনি জানেন, অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া নারীর মুক্তি নেই। তাই তিনি নারীদের দক্ষতাবৃদ্ধির প্রশিক্ষন পাইয়ে দিতে ভুমিকা রাখেন। যা নারীদের কর্মসংস্থান তৈরি করে, আয় বৃদ্ধি করে।
বিভিন্ন এনজিও ও সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে নার্গিস নিজেসহ এই গ্রামের নারীদের শাকসবজি চাষ, সূচিকর্ম, কাপড় সেলাই, গবাদি পশু পালন, কৃষি, হাঁস-মুরগি পালন এবং ক্ষুদ্র-ঋণ নিয়ে ব্যাবসা করে উপার্জনক্ষম ও স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করেছেন। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হওয়ার ফলে তারা পরিবারে নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুমিকা রাখতে পারছে।
বাল্যবিবাহ ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে
সচেতনতা বৃদ্ধি করে এনজিও এবং সরকারি উদ্যোগে মেয়েদের ক্ষমতায়ন ও আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলছে তার দল। তারা নিজেদের কমিউনিটির মধ্যে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করে উদ্যোগ গ্রহণ করছে। তাছাড়া বিভিন্ন নারী সংগঠনের আইনি সহায়তায় নারী নির্যাতন, যৌতুক প্রথা এবং পারিবারিক বিরোধ নিরসনেও কাজ করে যাচ্ছে।
নারীদের সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা পেতে সহায়তা করছেন নার্গিস। তারা মাসিক স্বাস্থ্য এবং কুসংস্কার নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনার ব্যবস্থা করছে, যা সামাজিক বাঁধা ভাঙতে সাহায্য করছে। জন্মনিরোধক ব্যবহার ও সহজলভ্য করতে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর সাথে সংযোগ রাখছেন তিনি। তাছাড়া গর্ভবতী নারীর স্বাস্থ্য ও যত্নের জন্য পাড়ায় পাড়ায় স্বাস্থ্যকর্মীদের সাথে নিয়ে নিয়মিত গ্রুপ মিটিং করেন । প্রসবকালীন ও প্রসবপরবর্তী জটিলতা এড়াতে নারীদের সবসময় সচেতন করছেন তিনি। শিশু জন্ম পরবর্তী ৫ বছরের জন্য পুষ্টি ভাতা পাইয়ে দিতে নার্গিস ইউনিয়ন পরিষদ ও সরকারি অন্যান্য দপ্তরে সমন্বয় করে যাচ্ছেন।
এলাকার রুমি ও মমতাজ বলেন, নার্গিসের সহায়তায় আমরা পুষ্টিভাতার কার্ড পেয়ে উপকৃত হয়েছি।
গোলেনুর বেওয়া বলেন, আমি বয়স্ক ভাতা পাই। আমার মতো আরও অনেককে ভাতা পাইয়ে দিয়েছেন নার্গিস।
তাছাড়া বন্যাকালীন বা দূর্যোগকালীন সহায়তা ও সচেতনতা তৈরিতে ভুমিকা রাখছে তার দল। তারা নিজেদের অধিকার সচেতন করছে, নেতৃত্ব বিকাশ ও রাজনীতিতেও সচেতন হয়েছে।
সুভারকুটি গ্রামের নারীদের জন্য কাজ করায় নার্গিসকে হলোখানা ইউনিয়ন পরিষদের লিগ্যাল এইড কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ক্রিশ্চিয়ান এইড, আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন' সম্মিলিত ভাবে Expanding civic space through active CSO participation and strengthened governance system in Bangladesh (ECSAP) নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রান্তিক নারী, দলিত, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, ট্রান্সজেন্ডার, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
কুড়িগ্রামের হলোখানা ইউনিয়নে 'মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন' এর অর্থায়নে এএফএডি(AFAD) এর Empowering Vulnerable Women in Kurigram(EVW)-Project
ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের ক্ষমতায়নে
সচেতনতামূলক কাজের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন, জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা দূরীকরণ এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতির জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
নার্গিস বলেন, ছোটবেলা থেকে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক বাঁধার সম্মুখীন হয়েছি। তবুও এই কাজগুলো যেন আমার রক্তের সাথে মিশে গেছে। আমি যখন নিজের এলাকার নারীদের ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো দেখি, আমার সকল কষ্ট ও ত্যাগ তুচ্ছ হয়ে যায়। যতদিন পারি আমি সকল নারীদের পাশে থেকে তাদের হাতকে শক্ত করতে চাই। ফুল যেমন নিজের জন্য ফোটে না, নার্গিস তো ফুলই। সেও অন্যের জন্য বাঁচুক।
এ প্রসঙ্গে এফএডির নির্বাহী পরিচালক সাইদা ইয়াসমিন জানান, সুভারকুটি গ্রামের এই দলটি নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে সরকারি বেসরকারি সেবা আদায় করে নিচ্ছে। তারা নিজেদের মডেল হিসেবে গড়ে তুলছে যা আশেপাশের এলাকার মানুষের জন্য অনুকরণীয়। এই দলটির নেতৃত্বে থাকছেন নার্গিস। এনজিও থেকে সরাসরি কোন সাপোর্ট না থাকায় এমন দলগুলোর দৃশ্যমান পরিবর্তন সম্ভব হয় না। তবুও এই দলটির সমন্বয় ও উদ্যম তাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে।
হলোখানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: রেজাউল করিম রেজা জানান, একজন চেয়ারম্যান হিসেবে ইউনিয়নের সকল নাগরিকের সংকট সমাধানে আমি কাজ করার চেষ্টা চালিয়ে যাই। যদি কোন ব্যক্তি বা সংগঠন নিজস্ব উদ্যোগে এলাকার কাজে এগিয়ে আসে আমার জন্য কাজ আরো সহজ হয়। নার্গিসের দলটির জন্য আমি সব সময় আন্তরিক থেকে কাজ করেছি, আগামীতেও তাদের যে কোন সংকটে আমার দরজা খোলা থাকবে।



































