ঢাকা,   শনিবার ০৪ মে ২০২৪

The South Asian Times | সাউথ এশিয়ান টাইমস

বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতা : ভেতরে কারণগুলো নেই, বলায় বারণ থাকতে পারে

মানস চৌধুরী

প্রকাশিত: ১২:৪০, ১ এপ্রিল ২০২৩

বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতা : ভেতরে কারণগুলো নেই, বলায় বারণ থাকতে পারে

অনেক দিন আগে বাংলাদেশে একজন নিরীহ, শান্ত, নম্রভাষী সাবেক বিচারপতি-রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তো তিনি ১৯৯৭ সালে একবার শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্র বিলি করার অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন, রাষ্ট্রপতিদের যা সাধারণ কর্তব্য। সেখানে কালো রঙের সোনালি লেইস লাগানো গাউন গায়ে দিয়ে একটা বক্তৃতাও তিনি দিয়েছিলেন।

এটাও রাষ্ট্রপতিবৃন্দের জন্য নৈমিত্তিক কাজ হিসেবেই মানতে হবে। সেই বক্তৃতায় তিনি ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে ‘পরামর্শ’ দিয়েছিলেন। তিনিও বাংলাদেশের হইচই সিভিল সমাজের কণ্ঠস্বরকে চিনতেন এবং সাব্যস্ত করেছিলেন ‘কেষ্টা ব্যাটাই চোর’। যত নষ্টের গোড়া এই ছাত্র রাজনীতি ক্যাম্পাস থেকে উৎখাত করার পরামর্শ তিনি দিচ্ছিলেন ক্যাম্পাস প্রশাসনকে।

তার এরকম ভালোমানুষিও অনেকের সহ্য হয়নি। আমারও হয়নি। আমি তদানীন্তন আজকের কাগজ পত্রিকায় ‘পরামর্শদানের রাজনীতি’ বলে একটা রচনা লিখেছিলাম। আজকের বাংলাদেশে এরকম একটা কাজ আমি হয়তো করতাম না। 


আমার রচনায় আমি কী লিখেছিলাম অবশ্যই আজ তা মনে নেই। তখন কম্পিউটার ব্যবহার করতাম না যে, এখন আবার রচনাটা খুলে একটু পড়ে নেব। তবে আমি নিশ্চিত যে পরামর্শটা কাকে দিচ্ছেন তিনি, কেন দিচ্ছেন, বিদ্যমান এই ক্ষমতার কারিগরি বা জারিজুরি তিনি আদৌ বোঝেন কি না, নাকি বুঝেও নিছক নিরীহ ভালো মানুষই থাকতে চাইছেন এসব প্রশ্ন না রেখে থাকতে পারিনি আমি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাগুলোর অভ্যুদয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পেটের মধ্য থেকেই হয়ে চলেছে এই আন্দাজটা সম্প্রচারিত করা অত্যন্ত বিরক্তিকর কাজ। যারা বুঝেও এটা করেন তারা একটা পরিষ্কার হঠকারিতা করেন, এমনকি স্পষ্ট প্রতারণা। যারা না-বুঝে এটা করতে থাকেন তারা দায়িত্বশীল পদে থাকলে আহাম্মকিতার অপরাধ করেন। দায়িত্বহীন পদে থাকলে, আমার মাথাব্যথা নেই। যা ইচ্ছে ভাবতে ও মাইক লাগিয়ে ঘোষণা দিতে থাকতে পারেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাগুলোর অভ্যুদয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পেটের মধ্য থেকেই হয়ে চলেছে এই আন্দাজটা সম্প্রচারিত করা অত্যন্ত বিরক্তিকর কাজ। যারা বুঝেও এটা করেন তারা একটা পরিষ্কার হঠকারিতা করেন, এমনকি স্পষ্ট প্রতারণা। 
এসব কথা বলার মাধ্যমে আমি কি অমুক বা তমুক উপাচার্য কিংবা তাদের পরিষদের প্রতি আমার ভক্তি শ্রদ্ধা প্রকাশ করে ফেললাম তাহলে? আমি নানান বিশ্ববিদ্যালয়ের পদাধিকারী লোকজনকে কীভাবে দেখি বা তারাও আমাকে কীভাবে দেখেন (মানে যারা একটু চেনেন আরকি) সেইসব ইতিহাসের জন্য অপ্রয়োজনীয় তথ্যাদি। তবে বিভ্রান্তি বা বিচলনের সুযোগ নেই।

আমরা কোনো পক্ষ অন্য পক্ষকে ভালো পাই না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃস্থানীয় লোকদের আমি মন্দ অভিপ্রায়সম্পন্ন, অদক্ষ, ভীরু, ক্ষমতালিপ্সু আউলা ইত্যাদি মনে করি বলেই সব দোষের নন্দ ঘোষ বানানোর কোনো কারণ পাই না।

আজকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় রাশি রাশি অসঙ্গতি, অস্বচ্ছতা, নাশকতা, অদক্ষতা, হিংস্রতা যা প্রকাশিত হচ্ছে তার সিংহভাগের কারকই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের উপাদান। এই উপাদানসমূহের একটা ছোটখাটো তালিকা বানাতে চাইলেও তা হবে এরকম—

-    জন-আমলাতন্ত্রের উচ্চমন্যতা, 
-    রাষ্ট্র-অনুগত কর্মচারী বানানোর সরকারি নকশা, 
-    সরকারের প্রোপাগান্ডা মেশিনের পরিবর্ধন, 
-    ছাত্রদের ভেতরে গুণ্ডাবাহিনি সৃষ্টির বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর আকাঙ্ক্ষা, 
-    বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাবৃদ্ধির হাততালি প্রাপ্তির ইচ্ছে, 
-    বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোর সাথে স্থানীয় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রতিবেশের কোনো সামঞ্জস্য বিধানের অনীহা,
-    পুরাতন কলেজগুলো পরিতোষণে অবহেলা,
-    জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে কল্যাণকর হিসেবে বলবৎ রাখতে ব্যর্থতা/অনীহা, 
-    ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ে (এদের মধ্যকার মোড়লগুলো) অগ্রগুরুত্ব প্রদানের নীতিমালা, 
-    সামরিক বাহিনিকে শিক্ষাখাতের অভিভাবক বানিয়ে তুলবার সেমিগোপন কৌশল, 
-    মেগাপ্রকল্প,
-    ঠিকাদারি,
-    বাচ্চা-ঠিকাদার হিসেবে সরকার-অনুগত ছাত্রদের তালিম নিতে উৎসাহ প্রদান। 


এটা একটা সম্পূর্ণ তালিকা নয়। সময় পেলে তালিকা লম্বা করতে পারব। আবার লম্বা করলেও তালিকায় সব যে আমি ভেঙে লিখব না তা হলফ করে বলতে পারি। উদাহরণ হিসেবে, ক্যাম্পাসগুলো যদি ‘কেউ’ মাদক বা যৌনতার একটা চেইন হিসেবে ব্যবহার করার স্বপ্ন দেখে থাকেন, তাহলে সেই স্বপ্নদ্রষ্টা কে হতে পারেন তা আমি আন্দাজ করতেও চেষ্টা করব না। এরকম আন্দাজ আপনারা করলেও আমি নিজ কানে সেটা শুনে বিপদ বাড়াতে চাইব না।

তাছাড়া যে রাস্তায় এই তালিকা আমি বানালাম, আমার মেথডোলজি না মেনেও আপনারা নিজেরাই এই তালিকা নিজের ইচ্ছেমতো লম্বা করে নিতে পারবেন। এই তালিকার কোনো অনুচ্ছেদ নিয়ে পাঠকদের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তারপরও যদি কেউ মনে করেন বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে, আমাকে বিশদ করতে বলতেই পারেন। আমি অবশ্যই সেটা করে দিতে চেষ্টা করব। পত্রিকার পাতায় না করে গোপনে করাই আপনার বা আমার জানমালের নিরাপত্তার জন্য সঠিক ও বিবেচনা সম্মত হবে তা। 

আজকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় রাশি রাশি অসঙ্গতি, অস্বচ্ছতা, নাশকতা, অদক্ষতা, হিংস্রতা যা প্রকাশিত হচ্ছে তার সিংহভাগের কারকই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের উপাদান।
তালিকার বেশকিছু হয়তো অন্তর্প্রবিষ্ট। সেটা তো হওয়ারই কথা। এখন লক্ষ্য করুন, এই তালিকার মধ্যে কোনোটা বা কতগুলো নিছক নিরঙ্কুশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যকার ‘নিজস্ব’ সমস্যা হিসেবে দেখতে পারছেন? শুরু থেকে দ্বিতীয়টা (রাষ্ট্র-অনুগত..) এবং একদম শেষেরটা (বাচ্চা-ঠিকাদার..) আধাআধি পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ বিষয় বা প্রপঞ্চ হিসেবে দেখতে পারবেন। কিন্তু বাকি আধাটাই, আসলে বড় আধাটাই, প্রণোদনা বা প্রেষণাই রাষ্ট্রের অন্যান্য দপ্তর থেকে আসছে।

তাছাড়া কিছু প্রপঞ্চ ঠিক প্রপঞ্চ নয়, বরং মহাপ্রপঞ্চ। যেমন ধরুন, ঠিকাদারি। ঠিকাদারি একটা নিখিল বাংলাদেশীয় উত্তেজনাকর প্রপঞ্চ, প্রায় প্যারাডাইমের মতো এবং ঠিকাদারিতে এমন এমন সব গুরুতর রাষ্ট্রবিভাগ আগ্রহী যে সবার নাম শরমে (বা ভয়ে) উচ্চারণ করাও মুশকিল।

সর্বশেষ

Advertisement

সর্বাধিক জনপ্রিয়