ঢাকা,   শুক্রবার ০৩ মে ২০২৪

The South Asian Times | সাউথ এশিয়ান টাইমস

বঙ্গবন্ধুর কলকাতা কথা : মহাজীবনের নির্মাণ ইতিহাস

অমিত গোস্বামী

প্রকাশিত: ১২:৪২, ১ এপ্রিল ২০২৩

বঙ্গবন্ধুর কলকাতা কথা : মহাজীবনের নির্মাণ ইতিহাস

পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর আবির্ভাব এক বৈপ্লবিক আত্মপ্রকাশ। একটা দেশের জন্ম দেওয়া একজন নেতার একক কৃতিত্ব পৃথিবীর ইতিহাসে প্রায় দুর্লভ। এই অসম্ভবকে সম্ভব করার পেছনে কারণ বর্ণনা করে প্রচুর শব্দ লেখা হয়েছে ইতিমধ্যে। কিন্তু তার রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠার নির্মাণ কাহিনিতে কলকাতার অবদান যে মুখ্য তা অনেক সময় আড়ালেই থেকে যায়।

যেকোনো নেতার রাজনৈতিক জীবন গড়ে ওঠার সময় তার ছাত্রাবস্থার শেষ কয়েক বৎসর। এই সময়েই ভিত তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধুর  রাজনৈতিক ভিত গড়ে দিয়েছিল কলকাতা। এই কথা তার আত্মজীবনীতে পরিস্ফুট। এই বিষয়ে আলোচনা করতে হলে বঙ্গবন্ধুর কলকাতা বাসের কিছু অংশ আমাদের একবার মনে করে নিতে হবে।

সেই সময়ের কলকাতা তখন সমগ্র পূর্ব ভারতের নিয়ন্ত্রক ছিল। গোপালগঞ্জে বড় হয়ে ওঠা বঙ্গবন্ধুর প্রথম কলকাতায় আগমন ১৯৩৪ সালে। তার বয়স তখন ১৪ বছর। তিনি তখন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। এই সময়ে তিনি বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। কলকাতায় তার চিকিৎসা হলো। ১৯৩৬ সালে বঙ্গবন্ধু আক্রান্ত হলেন গ্লুকোমায়। কলকাতা মেডিকেল কলেজে তার চোখের অপারেশন হলো।

১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জে অখণ্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এলেন। আলাপ হলো বঙ্গবন্ধুর সাথে। কিছুদিনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু চিঠি পেলেন শহীদ সাহেবের কাছ থেকে। তাতে লেখা—কলকাতা গেলে যেন বঙ্গবন্ধু তার সাথে দেখা করেন। সেই ছিল রাজ্যাভিষেকের প্রথম আহ্বান।

১৯৩৯ সালে বঙ্গবন্ধু কলকাতা আসেন বেড়াতে। শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করেন। শহীদ সাহেবের পরামর্শে ফিরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জে গঠন করেন মুসলিম ছাত্রলীগ। তিনি সম্পাদক হলেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর উৎসাহে গঠিত হলো মুসলিম লীগ।

১৯৪১ সালের মাঝামাঝি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার পরে রেজাল্ট বেরোতেই চলে এলেন কলকাতায়। এবার এলেন ছাত্র হিসেবে বসবাস করার জন্যে। বঙ্গবন্ধু কলকাতায় এসে ভর্তি হন তৎকালীন ইসলামিয়া বর্তমানের মৌলানা আজাদ কলেজে। থাকতে শুরু করেন বেকার হোস্টেলে। সেই সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অখণ্ড বাংলার শ্রমমন্ত্রী।

গোপালগঞ্জে বড় হয়ে ওঠা বঙ্গবন্ধুর প্রথম কলকাতায় আগমন ১৯৩৪ সালে। তার বয়স তখন ১৪ বছর। তিনি তখন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র।

বঙ্গবন্ধু কলকাতায় আসার পরে তার রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু হয়ে ওঠেন তিনি। বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ে লিখছেন, ‘আমি ছিলাম শহীদ সাহেবের ভক্ত। ...তিনি যে সত্যি আমাকে ভালবাসতেন ও স্নেহ করতেন, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার দিন পর্যন্ত।’

শহীদ সাহেবের নির্দেশে তরুণ বঙ্গবন্ধু ছুটে বেড়াচ্ছেন সারা বাংলায়। প্রাদেশিক নির্বাচন, দলীয় সম্মেলন বা জিন্নাহ সাহেবের আগমন, সব ক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধু কাণ্ডারি। ইসলামিয়া কলেজেও খুবই জনপ্রিয় ছাত্র নেতা। ১৯৪২ ও ১৯৪৩ সালে ছাত্র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ও তার পরের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হলো তার দল।

১৯৪৩ সালে শুরু হলো বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। এই সময় বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য হলেন। সেই সময় অখণ্ড বাঙলার প্রধানমন্ত্রী হলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী হলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। দুর্ভিক্ষের কারণে সৃষ্টি হয়েছে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি।

বঙ্গবন্ধু শহীদ সাহেবকে অনুরোধ করে ‘কন্ট্রোল’ দোকান খোলালেন। গ্রামে গ্রামে লঙ্গরখানা। বঙ্গবন্ধু ঝাঁপিয়ে পড়লেন পীড়িতদের সেবায়। ইতিমধ্যে তিনি ডাক পেলেন দিল্লিতে অনুষ্ঠিতব্য ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ সম্মেলন’-এ। গেলেন দিল্লিতে। নেতাদের বেশিরভাগ উর্দুতে বক্তৃতা দিলেন। খুব ভালো লাগল না বঙ্গবন্ধুর। তবু থাকলেন, দেখলেন। সম্মেলন শেষ হতেই ফিরে এলেন কলকাতায়।

১৯৪৪ সালে বাংলায় লীগ সরকারের পতন হলো। এরমধ্যে ইসলামিয়া কলেজে দলাদলির কারণে বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। তার নির্বাচন হয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ১৯৪৫ সালে ঘোষণা হলো যে ১৯৪৬ এর মার্চে নির্বাচন হবে। ভারতের মুসলমানরা পাকিস্তান চায় কি চায় না তা নির্ধারণ করতে।

১৯৪৬ এর নির্বাচনে স্পষ্ট রায় এলো পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হলেন। সেই বছর এপ্রিলের শুরুতে জিন্নাহ সাহেব মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সদস্যদের সম্মেলন ডাকলেন। বঙ্গবন্ধু স্পেশাল ট্রেনে শহীদ সাহেবের সাথে দিল্লি পৌঁছলেন। সেই সম্মেলনের পরে আজমীর শরীফ ও আগ্রা দেখে কলকাতা ফিরলেন বঙ্গবন্ধু।

জিন্নাহ সাহেব ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ঘোষণা করলেন ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে। সেইদিন তুমুল দাঙ্গা হলো কলকাতায়। তারপরে নোয়াখালীতে, তারপরে বিহারে। বঙ্গবন্ধু প্রথমে গেলেন বিহারে, তারপরে আসানসোলে এসে দুর্গতদের সেবা করলেন। কলকাতা ফিরলেন দেড় মাস পরে। কিছুটা অসুস্থ শরীরে। কিন্তু পড়াশোনার কারণে আত্মগোপন করলেন বাল্যবন্ধু শেখ শাহাদাত হোসেনের হাওড়ার বাসায়।


১৯৪৭ সালে বঙ্গবন্ধু পরীক্ষা দিলেন। ১৯৪৭ সালে জুনে ঘোষণা হলো ভারত ভাগ হবে। বঙ্গবন্ধু গেলেন সিলেটে গণভোট করতে। ফিরে এসে দেখলেন ক্ষমতার লোভে নেতারা দলাদলি শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে রেজাল্ট বেরোল। বঙ্গবন্ধু স্নাতক হলেন। বঙ্গবন্ধু পূর্বপাকিস্তানে ফিরলেন ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে। ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। এই মোটামুটি বঙ্গবন্ধুর কলকাতা বসবাসের ইতিহাস।

বঙ্গবন্ধু স্পেশাল ট্রেনে শহীদ সাহেবের সাথে দিল্লি পৌঁছলেন। আলাপ হলো জিন্নাহ সাহেবের সাথে। এই প্রাপ্তি তার অভিজ্ঞতায় নতুন মাত্রা সঞ্চার করল।
বঙ্গবন্ধুর কলকাতাবাস প্রসঙ্গ অবতারণার পূর্বে স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে বঙ্গবন্ধুর স্বাভাবিক নেতৃত্বগুণ বাল্যকাল থেকেই ছিল। এই গুণ দ্রুত পরিস্ফুট হয়েছিল দুটি কারণে।

প্রথমত অসুস্থতার জন্যে তার শিক্ষার তিনটি বছর নষ্ট হওয়ায় বঙ্গবন্ধু সহপাঠীদের চেয়ে বয়েসে বড় ছিলেন। স্বভাবতই ক্লাসের নেতৃত্ব তার হাতে বর্তেছিল।

সর্বশেষ

Advertisement

সর্বাধিক জনপ্রিয়